শিরোনাম

ধর্ম ও রাজনীতি: ভারতীয় উপনিবেশিক প্রেক্ষাপট



জাতীয় পরিচয় নিরুপনের আগে পরিচয় ব্যাপারটাকে অনুধাবন করা জরুরী। যদি এভাবে বলা যায় যে, পরিচয় হলো নিজ সত্তা সম্পর্ক সচেতনতা, তাহলে জাতীয় পরিচয় বলতে বোঝাবে কোন একটি জাতীয় প্রেক্ষিতে নিজসত্তা সম্পর্কত সচেতনতা। এই সংজ্ঞাটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করা যায় (যেমন:ভোট)। সুতরাং, পরিচয় কেবল নিজের ভেতরে সচেতন হওয়ার মত কোন ঘটনা নয়, বরং সেটি সত্তার বাইরে থাকা মানুষজনের অনুধাবনের জন্য সত্তাটির বিবৃতিও দাবি রাখে। এর একটি দিক অবশ্যই কোন যৌথ সত্তায় ওই ব্যক্তিসত্তাটির নিজেকে খুজে পাওয়া। এইরকম কিছু যৌথ সত্তা হলো :ধর্ম,বর্ণ,শ্রেণী,জাতিসত্তা ও লিঙ্গ। দেখা যায় যে,যেসব সমাজ অন্য সমাজ থেকে নিজেদের বাহ্যিক ভিন্নতাকে যেকোন প্রেক্ষিতেই প্রবলভাবে তুলে ধরে, তাদের মধ্যেও ভেতরে ভেতরে লিঙ্গ বৈষম্য বিরাজ করে।

বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদের দুইটি ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে। একটি হলো প্রথাগত বা মূলধারার মৌলবাদ এবং অপরটি হলো ভাববাদী মৌলবাদ। এবং এর পিছনে একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে।

কেবল ১৯৭১ এ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম হলেও এর আবির্ভাবের পিছনে বিভিন্ন ঐতিহাসিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আমরা এর পরিচয় সম্পর্কত বিভিন্ন ধ্যান ধারণার উত্থান পতন লক্ষ্য করতে পারি। বর্তমান বাংলাদেশ যা কিনা একসময় পূর্ব পাকিস্তান ছিল, অবিভক্ত উপমহাদেশে তা ছিল ভারতের বাংলা নামক প্রদেশের পূর্ব অংশ। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা চলে গেলে উপমহাদেশ স্বাধীন হলো এবং তা বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হলো। বিট্রিশ বিরোধী সংগ্রামেই মূলত ভারতের হিন্দু মুসলমানের ঐক্য গড়ে উঠেছিল, যদিও তাদের একত্রে বসবাসের পক্ষে সেটি বড় কারণ হয়ে দাড়াতে পারেনি। ভারতের একটি বড় জাতিগোষ্ঠী হিসেবে মুসলমানরা অবিভক্ত ভারতে বহুদিন ধরেই স্বায়ত্তশাসন দাবি করে আসছিল কিন্তু সংখাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে সেটা আদায়ে ব্যর্থ হওয়াতেই পাকিস্তান নামক সতন্ত্র রাষ্ট্রের উদ্ভব।

পাকিস্তান বানানোর ফর্মূলা যেহেতু মুসলিম অধূষ্যিত এলাকাজুড়ে ছিল তাই পাকিস্তান বলতে বাস্তবে দাড়াল ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমে পরষ্পর থেকে এক হাজার মাইল দূরে অবস্থিত দুটি খন্ড। এই দুই খন্ড খুব শিঘ্রই বুঝতে পারলো যে, শুধু মাত্র ধর্ম ছাড়া তাদের মধ্যে খুব কমই মিল ছিল।তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান নানা কারনে পূর্ব পাকিস্তানে উপর আধিপত্য কায়েম করলো।এর ফলে পূর্ববাংলার অধিবাসিরা মূলত পাঞ্জাবী জাতিপরিচয়ের পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিপরীতে বাঙালী জাতিসত্তার ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠল, ঠিক যেমন অবিভক্ত ভারতে তারা বাঙালি হিন্দুদের আধিপত্যবাদের বিপরীতে নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তান ভাগ হলো। পশ্চিম পাকিস্তান পাকিস্তান নামেই পরিচিত হলো এবং পূর্ব পাকিস্তানের নাম হলো বাংলাদেশ।

এবার ধর্মীয় বিকাশ ও বিস্তারের বিষয়টাতে আলোকপাত করা যাক। বাংলায় ইসলামের আগমনের প্রেক্ষাপটটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।বিভক্ত ভারতে ইসলাম ধর্ম ছিল নবাগত। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে মুসলমানরা ভারতে পৌছে এবং বাংলাদেশে পৌছায় ত্রয়োদশ খ্রিষ্টাব্দে। ততদিন এই দেশটি বিভিন্ন বিশ্বাসের বিচিত্র অধিবাসিদের জায়গা হযে উঠেছে। বাংলাদেশের ধর্ম ও উন্নয়ন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এবেকাসিস দেখিয়েছেন যে, বাংলাদেশের প্রথম কৃষিজ জাতিগোষ্ঠী আসে দক্ষিণ এশিয়া থেকে। তারা তাদের সঙ্গে শুধু যে তাদের দক্ষতা, শস্য চাষরীতি এবং গো-মহিষাদি এনেছিল তা নয়, সঙ্গে আরো এনেছিল তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, যেখানে মৃতের পুজা একটি গুরুত্বপূর্ন আচার হিসেবে ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ সালে গাঙ্গেয় জাতির বাংলায় আগমনের সাথে সাথে তারা যে হিন্দু সংস্কৃতি বয়ে এনেছিল তা পূর্বর সংস্কুতিকে বিনাশ না করে আত্তীকরণ করে নেয়। আরো এক হাজার বছর পর বৌদ্ধ ধর্ম এর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। তিনি আরো বলেন, বিদ্যমান গোত্রসমূহে বৌদ্ধ ধর্ম একটি নতুন ধর্ম হিসেবে আরোপিত হলেও তা তাদের সর্বপ্রাণবাদী চর্চাগুলোকে সমাজ থেকে উতখাত করতে পারেনি। এভাবে বিভিন্ন রাজ শাসনে হিন্দু ব্রাক্ষণ্যবাদ, উত্তর ভারতের হীনযান বৌদ্ধবাদ ও মহাযান বৌদ্ধবাদ বার্মার বৌদ্ধ ধর্ম সব একসাথে মিলেমিশে গেল, যদিও গ্রামাঞ্চলে বাশবন এবং ভূতপ্রেতে সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা অব্যাহতই থাকল।” তিনি আরো যোগ করেন, ইসলামের আগমনের সময়ে এখানকার জনগোষ্ঠির যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তা মূলত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দন্দ্ব ও মিলনের নিরবচ্ছিন্ন খেলায় গড়ে উঠেছিল।

মুসলিম দিগ্বিজয়ী আস্তে আস্তে ভারতবর্ষ আসা শুরু করে এবং তাদের শাসন কায়েম করতে থাকে। একই সাথে মুসলিম বনিক ও সুফিদের মা্ধ্যমে বিজয়ী শাসকের ধর্ম ছড়াতে থাকে। উত্তর ভারতের দুই কূলে পাকিস্তানের দুই অংশের এমন অদ্ভুত বিন্যাস এটি স্পষ্ট করে যে, ইসলাম যত না বিজয়ীর ধর্ম হিসেবে বিজিতের উপর চাপানো হয়েছে, তার চেয়েও বেশি ছড়িয়েছে ধর্মান্তরের প্রক্রিয়ায়। মূলত মুসলিম শাসকেরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল একটি প্রসাশনিক ব্যবস্থা এবং একটি ভাষা; কিন্তু মুষ্টিমেয় কয়েকজনের কথা বাদ দিলে এটি নিশ্চিত করে বলা যায় যে, এখানকার লোকয়ত জনগোষ্ঠীকে মুসলমান করে তোলার কোন অভিসন্ধি তাদের ছিল না।

সুফি সাধকেরা যে ইসলামের প্রচার করেন তা প্রাতিষ্ঠানিক ইসলাম ছিল না। সেটি খোদার সাথে আধ্যাত্নিক মিলনের ওপর জোর দিত এবং তার নবীনতম অনুসারীকেও সাবেকী ধ্যানধারনা একেবারে ছেড়েছুড়ে আসার জন্য চাপ দিত না। এভাবেই প্রাচীন বাংলায় ইসলাম একটি সমন্বয়বাদী ধর্মে পরিনত হয় ।

বাংলাদেশে গঙ্গাযমুনা নামে একটি বিশেষ ধরনের রৌ্প্য অলংকার আছে।এই নামটি এসেছে বাংলাদেশের গঙ্গা ও যমুনা এই দুটি নদীর নাম থেকে। কথিত আছে যে,যে মোহনায় নদী দুটি মিলেছে সেখানে দুটি স্রোত ধারার দুই রকম রং । এই অবস্থার সাথে মুসলমান মানসের এক অদ্ভুত মিল আছে। কারণ এ দেশের মুসলিম মানসে ইসলাম ও প্রচলিত সংস্কার গঙ্গাযমুনার মতোই মিশে প্রবাহিত হয়ে গেছে। এই মিলন একদিকে যেমন সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে, অন্যদিকে তেমনি বিরোধও সৃষ্টি করেছে। বিরোধগুলো কিছু কিছু চিন্তার ক্ষেত্রে অপরিহার্য রূপে সিজোফ্রেনিয়া তৈরী করেছে ( সিজোফ্রেনিয়া এক ধরনের মানসিক রোগ।এটির ফলে চিন্তার অগোছালো,অসুস্থ অবস্থা তৈরী হয়)ইসলামী সংস্কারবাদী আন্দোলনের মা্ধ্যমেই এই অসুস্থতার শুরু।

বাংলাদেশের মুসলিম সংস্কারবাদী আন্দোলন যখন একদিকে এদেশের ইসলাম চর্চাকে সিনক্রেটিক আলামত মুক্ত করার প্রয়াসে নেমেছে,একই সময়ে,তাদের আন্দোলন এমন এক শ্রেনী চেতনা তৈরি করে যা হিন্দু জমিদার ও ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে বাংলার কৃষককে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহাস্য করে। সংস্কারপন্থীরা কুরআন শুদ্ধ উচ্চারন অনুসরনের কথা বলতেন। কিন্তু সমস্যা হলো,তারা যখন ইসলামের নামে অনৈসলামিক চর্চাগুলো বাদ দেওয়ার আহ্বান জানাতেন তখন তারা জনগনকে তাদের জাতিগত উংস থেকে ছেটে ফেলাকে আবশ্যক মেনে করেনি ।

সংস্কারবাদীরা তাদের সংস্কার কর্মসূচিকে হিন্দু জমিদারদের বিরোধিতা পর্য়ন্ত বিস্তৃত করেছেন। বিভিন্ন পুজা পার্বনে তাদের খাজনা আদায়ের প্রক্রিয়াকে অনৈসলামিক আখ্যা দিয়েছেন।এসমস্ত খাজনা প্রদান গরিব মুসলমান কৃষকদের জন্য খুবই কষ্টকর ছিল। ব্রিটিশ উপনিবেশের সাথেও তাদের সংঘাত ছিল, এজন্য নয় যে তারা নিয়মিত খাজনা আদায় করত এবং খাজনা আদায় করতে গিয়ে তারা গিয়ে তারা যে মধ্যস্বত্ব্যভোগী জমিদার শ্রেনী তৈরী করেছে এজন্য। এভাবে ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতি বাঙ্গালী মুসলমানকে তাদের উপর চলতে থাকা শ্রেনী শোষন সম্পর্ক এ সচেতন করে তোলে।

মূলত তাদের মধ্যে ধর্মীয়ও শ্রেনীপরিচয় একই সঙ্গে এবং স্ববিরোধিতাসহই অবস্থা করছিল এবং সেই স্ববিরোধিতা পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমেও ঘোচানো যায়নি। সুতরাং সংস্কার আন্দোনের চেতনা পর্দার আড়ালেই থেকে গেল।

এবার আশা যাক ইসলামের রাজনৈতিক বিষয়টাতে। সংস্কারপন্হীদের জমিদারবিরোধী আন্দোলনের মা্ধ্যমেই বাংলার কৃষকদের চেতনা জাগ্রত হয়েছিল। এই চেতনারই ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশদের কাছ থেকেই স্বাধীনতা লাভের আশা জাগ্রত হয়। যুদ্ধ চলে দুই ফ্রন্টে,শুধু ব্রিটিশদের কাছ থেকে নয় সাথে সাথে হিন্দু জমিদার আগ্রাসনেরও পরিসমাপ্তি যটে। হিন্দু জমিদারের বিরুদ্ধে মুসলিম কৃষক সংঘাতের এহেন চেহারা ধর্ম ও শ্রেনীসংগ্রামকে মিলিয়ে দিয়েছিল। ফলে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলমানরা জোরে শোরে তাদের ধর্মীয় পরিচয় বিবৃত করেছিল। অংশত এটি ছিল এরকম যে বাংলা হলো হিন্দুদের ভাষা, যদিও পূর্ববাংলার হিন্দু মুসলমান উভয়ই বাংলায় কথা বলে। একইভাবে, উর্দু দিল্লি ও লক্ষ্নৌর ভাষা হলেও, হিন্দু মুসলমান ভাষাভাষী এই ভাষায় প্রায় সমান সংখ্যক থাকলেও সেটা হলো মুসলমানের ভাষা। সারা ভারতের আনাচে কানাচে উর্দু ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল,এমনকি দক্ষিন ভারতের হাইদ্রাবাদ এবং মিসৌরেও, এতে এ ধারণা বেশ পোক্ত হয়ে দাড়ালো। রাজনৈতিকভাবে ভারতের মুসলমানদের ভাষা নির্ধারিত হয়েছিল মুসলমানীকরণের একটি সচেতন চেষ্টার মধ্য দিয়ে। ভাষা বিষয়ে এই দৃষ্টিভঙ্গি পূর্ব পাকিস্তানে গ্রহনযোগ্যতা পায়নি। কারন সেখানে বাংলা ছিল সংখ্যা গরিষ্ঠের ভাষা। পরে এটি আরো স্পষ্ট হলো যে, উর্দুকে একমাত্র ভাষা হিসেবে রাখলে পশ্চিম পাকিস্তানি ঐক্য আরো মজবুত হয়। কেননা, এটা পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এই ধারনাও বাঙ্গালীদের আরো একলা করে দিল; কারণ বাংলা ভাষাভাষী হওয়ার কারনেই তারা ছিল ওই ঐক্য প্রক্রিয়ার বাইরে। এইসকল আঞ্চলিক ও ভাষাগত ভিন্নতার সেতুবন্ধন বাদ দিলে, মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সবার কাছে কোন অর্থই বহন করেনি। যেমন:মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল মৌলবাদিরা; কারণ তাদের মতে, এই ধরনের জাতীয়তাবাদ অনৈসলামিক। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এ গোটা সময়ে পূর্বপাকিস্তান তার নিজস্ব জাতিগত ও ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের শেকড়েই ভিত্তি রেখেছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙ্গালির ওই সমস্ত বৈশিষ্ট প্রকাশের জন্য একটা দারূন সুযোগ হয়ে দাড়িয়েছিল ।